এইচ এম জুয়েলঃ কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালে মাসিক বা ঋতুস্রাব বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভীষণ লজ্জাজনক। এদেশের বেশিরভাগ মেয়েদের বিশেষ করে গ্রামীন নারীদের জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই শব্দটি উচ্চারণের জন্য লজ্জা পেতে হয়েছে।
কেন এই স্বাভাবিক এবং মর্যাদার বিষয়টি সকলের কাছে এত লজ্জাকর এ ব্যাপারে “চ্যাপ্টহার” ফাউন্ডেশনের কর্ণধার ফাতিহা” তা এখনো বুঝে উঠেনি। তিনি বলেন একটা নারীর সৃষ্টির রহস্য শৈশব থেকে কৈশোরের পদার্পণের সাথে সাথে দৈহিক গঠনের লক্ষ্যে এটা একটি পরিবর্তন মাত্র এবং মাতৃত্ব গঠনের মূল লক্ষণ মাসিক/ঋতুস্রাব এটা লজ্জার কোন বিষয় নয়।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের ৫৩% কিশোরী মেয়েরা তাদের প্রথম মাসিক হবার আগে মাসিক সম্পর্কে জানতো এবং ৪১% মেয়েরা তাদের মাসিক চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। নরীদের জীবনে ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রত্যেকটি নারীকেই এই বিষয়টির সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশের বয়স প্রজনন-কালের মধ্যে। বেশিরভাগ মহিলার ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময়কাল প্রতি মাসের দুই থেকে সাত দিন। তবুও এই স্বাভাবিক নিয়মটাকে আমাদের সমাজ ট্যাবু হিসেবে দেখে। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষের ঋতুস্রাব সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটুকু নেই। সঠিক তথ্য এবং জ্ঞানের অভাবে তাদের মধ্যে অনেক ভুল ধারণার জন্ম নেয়। আর তা থেকেই শুরু হয় লিঙ্গ বৈষম্য। আমাদের এই অজ্ঞতা এবং ভুল ধারণার কারণে একটি কিশোরী বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়, কৈশোরের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। একটা সময় তাদের মনে ঋতুস্রাব নিয়ে ভয় হতে শুরু করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা মতে, একজন মহিলার মাসে গড়ে তিন থেকে সাত দিন হারে জীবদ্দশায় প্রায় ৭ বছর মাসিক হয়।
সারা বিশ্বের কোথাও কোথাও প্রথম মাসিক উদযাপন করা হয়। আবার কোথাও এটা একটি মেয়ের জীবনে ভয় বা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । প্রতিটি মেয়ের জন্য, এই সূচনা নারীত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এই সময়ে তাদের পরিবারের সহযোগিতা খুব বেশি প্রয়োজন এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে তাদের পাশে দরকার।
এই সমস্যা সমাধানের সূত্রপাত ধরে, ২০২১ সালে ফাতিহা ChaptHer Foundation(চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশন) এর যাত্রা শুরু করে। ChaptHer(চ্যাপ্টহার) অর্থাৎ Chapter Her(চ্যাপ্টার হার) ফাতিহার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ Chapter(চ্যাপ্টার) হয়ে দাঁড়ায়। চ্যাপ্টহার ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য একটাই – সকলকে MHM অর্থাৎ Menstrual health management সম্পর্কে অবগত করা এবং সমস্যাগ্রস্থ্য সকলের কাছে সাশ্রয়ী পিরিয়ড প্যাড পৌঁছে দেয়া। বেশ কিছু সফল প্রকল্পের মাধ্যমে তারা এখন পর্যন্ত ৪০০০ মানুষকে অনলাইন এবং অফলাইনে মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা বিনামুল্যে প্রদান করেছে। তাদের লক্ষ্য সবাই যেন মাসিককে লজ্জার চোখে নয় বরং মর্যাদার চোখে দেখে এবং একটি মেয়েরও লেখাপড়া মাসিকের জন্য যেনো ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
ফাতিহা -তার চারপাশ থেকে শোনা কুসংস্কার থেকে বের হয়ে এসেছে । এখন তার স্বপ্ন বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়েই যেনো এসব প্রচলিত কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসে।
বিশ্বব্যাপী, ২.৩ বিলিয়ন মানুষের স্যানিটেশনের মৌলিক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে জনসংখ্যার মাত্র ২৭ শতাংশের বাড়িতে পানি এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুবিধা রয়েছে। বাড়িতে পিরিয়ডের সময়ে মৌলিক সুবিধাগুলিও তারা পায় না।
নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে প্রায় অর্ধেক স্কুলে পর্যাপ্ত পানীয় জল, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির অভাব রয়েছে যা মেয়েদের পিরিয়ড-কালে খুব অসুবিধেয় ফেলেছে।
UNICEF – এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিশ্বের বহু মেয়েই অনেক সময় এই নিয়ে মানসিক চাপ, লজ্জায় ভোগে। ইউনিসেফ আরো মনে করে, ঋতুস্রাব শুধুমাত্র নারীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকলেও এই সম্পর্কে পুরুষদেরও ধারণা থাকা জরুরি। কেননা একটি ছেলে কারো ভাই, কারো বাবা,কারো বন্ধু,কারোর স্বামী। তাই মেয়েটির সুরক্ষায় শারীরিক সম্বন্ধে ধারণা রাখাটা বাঞ্ছনীয়।
চ্যাপ্টহার’ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার (ফাতিহা ) আরো বলেন – নারীরা পিরিয়ড সম্পর্কে না-জানার কারণে অনেক বড় সংক্রমণ হতে পারে। এটি প্রজনন এবং মূত্রনালীর সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত তাই পর্যাপ্ত পানি এবং কম খরচে মাসিক সরঞ্জাম থাকলে ইউরোজেনাইটাল রোগ থেকে বাঁচতে পারে।
বিশেষভাবে অক্ষম মহিলারা মাসিকের সময় অতিরিক্ত সমস্যায় ভোগেন। তাঁদের পিরিয়ডের সময় টয়লেটে যাওয়ার অসুবিধে হয়। হাতের কাছে স্যানিটারি প্যাডের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও থাকে না বহুসময়।