সিলেটে দুই চা শ্রমিকের সন্তান ভূমি ছাড়া চাকরি পেল
এইচ এম জুয়েল:- সরকারি বিধি মোতাবেক ২০২১ সালে পুলিশ কনস্টেবল পদে বিজ্ঞপ্তি পেয়ে সাধারণ নারী কোঠায় আবেদন করেন বরিশালের আসপিয়া ইসলাম কাজল ও খুলনার মিম আক্তার।কিন্তু নিয়ম মাফিক শারীরিক যোগ্যতা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাসহ ৭টি ধাপেই উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত নিয়োগের সময় নিজেদের স্থায়ী ভূ-সম্পত্তি না থাকায় পুলিশে চাকরি আটকে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন দেশের সংবিধানে সকলের জন্য সমান অধিকার কোথায় উল্লেখ নেই যে ভূমি ছাড়া চাকরি হবে না।
আইনে যা বলা আছে সংবিধানের ২১, ২৯, ১৩৩ ও ১৩৬ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে প্রণীত ওই আইনে প্রজাতন্ত্রে নিয়োগের বিধানাবলি যুক্ত রয়েছে। আইনের ৭ ধারায় সরকারের কর্মবিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিধানের সঙ্গে ‘বাংলাদেশের নাগরিক নয়, এমন কোনও ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করা যাবে না’ বিধানটি যুক্ত রয়েছে। আইনে নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে ভূ-সম্পত্তি থাকা বা স্থায়ী নাগরিক হওয়ার বিষয়ে কোনও কিছুই বলা নেই।
জমি-ঘর পেলেও আসপিয়ার পুলিশ নিয়োগের অনিশ্চিত।
বিধি অনুযায়ী পুলিশের চাকরির আবেদনের সময় তাঁর স্থায়ী ঠিকানা দিতে হয়।আসপিয়ার ব্যাপারে বরিশালের পুলিশ সুপার মো. মারুফ হাসান বলেন, ‘আমাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। আমরা আসপিয়াকে বাদ দিইনি। আবার অ্যাকসেপ্টও (গ্রহণও) করিনি। তবে যদি কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে নিয়মের মধ্যে থেকে নিতে হবে।’ বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম আক্তারুজ্জামান বলেন, জেলাভিত্তিকভাবে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ হয়। এ ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীকে অবশ্যই জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে -এমন বিধান রয়েছে। আবেদনের সময় তাঁর স্থায়ী ঠিকানা ছিল কি না, বিধি অনুযায়ী সেটাই ধরা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো নির্দেশনা পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সুরাহার উদ্যোগ নিতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
আসপিয়া সাংবাদিকদের বলেন চাকরি সংশ্লিষ্ট কোনো চিঠি বা খবর আমাকে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
উল্লেখ্য গত সেপ্টেম্বরে বরিশাল জেলায় পুলিশ কনস্টেবলের শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে অনলাইনে আবেদন করে আসপিয়া । এরপর শারীরিক যোগ্যতা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাসহ ৭টি ধাপেই উত্তীর্ণ হয়।চূড়ান্ত নিয়োগের আগে জেলা পুলিশের (ভেরিফিকেশন রুলস) প্রতিবেদনে আসপিয়া ও তাঁর পরিবারকে ভূমিহীন উল্লেখ করা হয়। এবং গত বুধবার জেলা পুলিশ সুপার বরাবর প্রতিবেদন জমা দেন হিজলা থানার উপপরিদর্শক মো. আব্বাস।
আছপিয়ার চাচা মোশারেফে হোসেন মাতবর সাংবাদিকদের বলেন আছপিয়া ইসলাম কাজলের বাবা আমার আপন ছোট ভাই। ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের আমরা বাসিন্দা। আছপিয়ার বাবা মৃত শফিকুল ইসলাম পরিবারের অমতে বিয়ে করে হিজলায় থাকেন।সেই থেকে আমাদের পরিবারের সাথে মূলত দূরত্বের সৃষ্টি হয়।এবং ২০১৯ সালের মারা যান। তবে আসপিয়া ভোলায় দাদার বাড়ী পৈত্তিক সম্পত্তি হিসাবে ১০ শতাংশ ভাই-বোনে পাবে।
হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ঝন্টু বেপারী ও স্থানীয় সংবাদিকরা বলেন শফিকুল হিজলা বাজারে মেজবাহ উদ্দিন অপু চৌধুরীর সমিল, রাইচ মিলে ম্যানেজার হিসেবে প্রায় ৩০বছর কাজ করত এবং অপু চৌধুরীর বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতো।
এ বিষয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বকুল চন্দ্র কবিরাজ দৈনিক তৃণমূল সংবাদ কে বলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসপিয়ার পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. জসীম উদ্দিন হায়দার এর আদেশক্রমে আছপিয়া ও তার মাকে নিয়ে খুন্না গোবিন্দপুরে সরকারি খাস জমি দেখিয়েছি এবং ২শতাংশ জমির উপর ঘর নির্মাণ করার জন্য কিছু ইট-বালু এনে কাজ শুরু করছি তবে জমি হস্তান্তর করা হয়নি, প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
মেধাতালিকায় প্রথম হয়েও ভূমিহীনের কারণে পুলিমের চাকরি পেলেন না খুলনার মিম আক্তার
চাকুরী হবেনা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিমের পরিবার। খুলনার পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে শনিবার তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তাকে চাকরি দেওয়া যাচ্ছে না।
মিম সংবাদিকদের জানিয়েছেন: পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে সাধারণ নারী কোটায় আবেদনের পর ২৫ অক্টোবর শিরোমণি পুলিশ লাইন্সে শারীরিক যোগ্যতা যাচাইয়ে আমি উত্তীর্ণ হই।”
এরপর ৮ তারিখে লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হই।পরে জানতে পারি আমি মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছি।পরে খুলনা থেকে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়।
এরপর পুলিশ ভেরিফেকিশেন শুরু হয়। সোনাডাঙ্গা থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও সিটিএসবি থেকে তদন্তে যায় পুলিশ। মিম বলেন, তাদের কাছে “ভূমিহীন সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি।এরপর ফোন দিয়ে পুলিশ লাইন্সে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য আমাকে ডাকা হয়। মিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার সাথে যারা ফিঙ্গার দিয়ে ছিলো তাদের ডাকলেও আমাকে ডাকেনি।
আমি শনিবার খুলনার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গিয়েছি। পুলিশ সুপার স্যারকে না পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভির আহম্মেদ স্যারের সঙ্গে দেখা হলে।তিনি বলেছেন, তোমার সব ঠিক আছে। তবে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তোমাকে চাকরিটা আমরা দিতে পারছি না।”
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভীর আহম্মেদ এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের বলেন, “মেয়েটা সব দিক দিয়েই পারফেক্ট। মেধাতালিকায় প্রথম হয়েছে। তবু পুলিশের রুলসের কারণে আমরা তাকে চাকরি দিতে পারছি না। জন্ম এখানে হলে বা জন্ম সনদ এখানে থাকলেই হবে না। স্থায়ী ঠিকানা লাগবে। আইনের বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না।
মিমের বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, পৈত্রিক বাড়ি বাগেরহাট চিতলমারি উপজেলার বড়বাড়িয়া গ্রামে সেখানে আমার নামে কোনো জমি নেই।১৯৮৮ সাল থেকে ভাড়াটিয়া হিসেবে খুলনায় বসবাস করে আসছি। এখন ভূমিহীন বলে আমার মেয়ের চাকরিটা হচ্ছে না।
ভূমির মালিক না হয়েও পুলিশে চাকরি পেলেন সিলেটের দুই চা শ্রমিক
২০১৭-তে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ উপজেলার দুই চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান কলিন্স রোজারিও ও রাজু প্রসাদ কৈরী পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছিলেন।
২০১৬ সালের মৌলভীবাজার পুলিশ লাইন্স মাঠে কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়েছিল তাদের।
কিন্তু ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল। কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া থানার ওসিকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘এ দুজনের ভূ-সম্পত্তি না থাকায় যাচাই (ভেরিফিকেশন রুলস) বা তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বর্তমানে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত পুলিশ সদস্য কলিন্স রোজারিও বলেন, ‘পুলিশের চাকরির ক্ষেত্রে ভূ-সম্পত্তি বাবা ও মায়ের নামে থাকতে হবে এমনটাই বাহিনীর রুলস। আমি বংশপরম্পরায় চা-বাগানে বাস করছি। আমার স্কুল-কলেজে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে চা-বাগানের ঠিকানাই দেওয়া আছে। আমাদের নিজস্ব জমিজমা নেই।
তবে স্থায়ী নাগরিক হিসেবে আমরা দুজনই (কলিন্স ও রাজু) যথেষ্ট প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছি পুলিশের আইজি স্যারের বরাবরে। পরে আইজি স্যারের নির্দেশে আমাদের দুজনের ‘২০১৭ সালে চাকরি হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমার জানা মতে, পুলিশে এরকম একটি বিধান ছিল। জেলা কোটার বিষয়ে যেমন, বাপ-দাদার জমি কোথায় সেগুলো তারা দেখে থাকে। এটা তাদের প্রচলিত নিয়ম ছিল, সেটা হয়তো তারা অনুসরণ করছে।’
অতীতে এরকম ঘটনার অবতারণা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলাম। কিন্তু কেন যে এটা আবারও তারা করলো, তা আমি জানি না। তারা হয়তো এটা খেয়াল করেনি। এটা কেন হয়েছে সেটা সব দেখে ব্যবস্থা নেবো।