এইচ এম জুয়েল :- ১৫ নভেম্বর ২০০৭ এই দিনে বাংলাদেশের সুন্দারবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে ভয়ানক (সুপার সাইক্লোন) ঘূর্ণিঝড় সিডর।সাগর মোহনায় বলেশ্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর উৎপত্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে উপকূলীয় জেলাতে। এর আঘাতের লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় জনপথ। হাজার হাজার লোক মারা যায়। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক গবাদিপশু ও মাছ-বৃক্ষ ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে এ অঞ্চলের মানুষ। স্বজনরা এখনও তাকিয়ে আছে আপনের পানে কখন আসবে ফিরে। সিডরের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো অনেক অংশে এখনও সেরকম মেরামত হয়নি।এ অঞ্চলে সিডরের পরেও একাধিকবার হয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কিন্তু তাদের ভোগান্তি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কবে পাবে তারা টেকসই বেড়িবাঁধ সে আশায় বুক বেঁধে তাকিয়ে আছে।
৩২টি জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সিডরে ক্ষতি হয়েছিল ৫০ লক্ষ মানুষের। রেড ক্রিসেন্ট তথ্যমতে মারা গেছে ১০ হাজারের অধিক কিন্তু সরকার বলছে ৬ হাজারের মত। পানির উচ্চতা ছিল ১৫ থেকে ২০ ফুট কিন্তু কপাল ভালো সময়টা ছিল ভাটা নইলে জোয়ার থাকলে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে আরো প্রাণহানি হত। সুন্দরবনের কারণে বাতাসের গতি কিছুটা থমকে ছিল।
সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয় বাগেরহাট,বরগুনা ও পিরোজপুর। সরকারি হিসাবে বাগেরহাট জেলায় নিহত হন ৯০৮ জন ও আহত হন ১১ হাজার ৪২৮ জন। বরগুনা জেলায় মারা যান ১ হাজার ৩৪৫ জন। নিখোঁজ ছিলেন ১৫৬ জন এবং পিরোজপুর জেলায় ৫৫০মত মারা যান। আহত ও নিখোঁজ বেশ কিছু।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা ছিল বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়ন আর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ও ইন্দুরকানীর কিছু অংশ।
এদিকে: সিডর দিবস উপলক্ষে উপকূলীয় জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গুলো শোক সভা মধ্য দিয়ে সিডর সহ বিভিন্ন সাইক্লোনের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা, টেকসই বেড়িবাঁধ সহ ও পুনর্বাসনের দাবি তোলেন।
সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো স্বজন হারা বেদনা নিয়ে কোরআন খানি দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করেন।
সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনসংলগ্ন মাঝেরচর বাসী প্রতিবেদককে বলেন, সিডরের সেই ভয়ানক তান্ডব স্মৃতি আজও মন মনে পড়লে শিউরে উঠে। চোখ বন্ধ করে বলে সেদিন নদীর মাঝ থেকে আগুনের ঝালক (ফুলকি) বাতাসে উড়ে ছিল। মিনিটের মধ্যে ঘরের চালের উপর পানি উঠে যায় দিশেহারা হয়ে পড়ি।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ
নামকরণ বিষয়টি সমন্বয় করে ভারতের দিল্লির ‘রিজিওনাল স্পেশালাইজড মেটেরিওলজিক্যাল সেন্টার’। যদিও বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় এই নামকরণের চল অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়কে সাইক্লোন বলা হলেও আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় হারিকেন ওপ্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বলা হয় টাইফুন।
কিন্তু এর আগে এঅঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হত নায় প্রথম ২০০০ সাল থেকে ঝড়ের নামকরণের জন্য নিয়ম বানানো হয় এ অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে, তার নাম দেওয়া হয় ২০০৪ সালে।
তাতে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইডেট নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য ৮টি দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড৷ সব দেশের কাছ থেকে ঝড়ের নাম চাওয়া হয়৷ তার থেকে প্রথম দফায় দেশ প্রতি ৮টি করে নাম বাছাই করে মোট ৬৪টি ঝড়ের নামকরণ করা হয়৷ সেই তালিকার শেষ তারপর আবার নতুন তালিকায় আরও পাঁচ দেশ যুক্ত হয়েছে। ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমির, ইয়েমেন ও কাতার। এই ১৩টি দেশ মিলে নিজেদের বিবেচনা করা নাম জমা করে তারপর একটা তালিকা বানিয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্ত দেশকে পাঠানো হয় তার পর চূড়ান্ত তালিকা।’
বাংলাদেশের দেওয়া প্রথম নামটি ছিল অনিল। সিডর নামটি ছিল শ্রীলঙ্কার দেওয়া। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে ২০০৭ সাল থেকে।
সরকারি তথ্য অনুসারে ১৯৬০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম সিডর।
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়
** বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড়- ১৮৭৬ সালের ১লা নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি অনেকের কাছে বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। তাতে প্রাণ হারিয়েছিল ২ লাখ মানুষ, যখন ১০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়।
. ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়: ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার৷ এটি মূলত চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়েছিল৷ ঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ২৯-৩০ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে। এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এক কোটির বেশি মানুষ।