এইচ এম জুয়েলঃ- উপমহাদেশের প্রখ্যাত কিংবদন্তি নির্ভীক আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার (আজ পহেলা জুন) ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে একটানে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্বপ্নস্রষ্টা।
ঢাকা আজিমপুর জাতীয় গোরস্থানে মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও মোনাজাত করেন সুযোগ্য উত্তরসুরী জ্যেষ্ঠ সন্তান ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও কনিষ্ঠ সন্তান সাবেক মন্ত্রী সংসদ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো আপস করেননি।
১৯৬৯ সালের এই দিনে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক। ভাগ্য-বিড়ম্বিত বাঙালি জাতির জীবন-সংগ্রাম, অস্তিত্ব-আত্মমর্যাদা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রেরণা প্রদানকারী শক্তির উৎস হয়ে উঠেছিলেন তিনি এবং তার প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’। তার সংগ্রামদীপ্ত জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সাংবাদিকতার দায়িত্ববোধ জড়িয়ে ছিল।
এদিকে নিজ জন্মভূমি ভান্ডারিয়ায় দোয়া ও আলোচনায় করেন তার ভাতিজা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মহিবুল হোসেন মাহিম।
এসময় আরো আলোচনা করেন ভান্ডারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সীমা রানী ধর, সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল আমানুল্লাহ আমান, আওয়ামী লীগের সভাপতি আইজুল রশিদ খসরু, জাতীয় পার্টির যুগ্ন আহবায়ক গোলাম সরোয়ার জমাদ্দার, সদস্য সচিব সিদ্দিকুর রহমান টুলু, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মৃধা, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা খান মোঃ রুস্তম আলী, থানার তদন্ত ইন্সপেক্টর, বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য বৃন্দ, মাজেদা বেগম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ, মানিক মিয়া কলেজের অধ্যাপিকা সহ উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজ গণ।
পৈত্রিক ভিটা পূর্ব ভান্ডারিয়া মন্ত্রী বাড়ি জামে মসজিদে মানিক মিয়ার আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
মানিক মিয়া ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তাকে মানুষের অধিকারের কথা বলতে হয়েছে।
মানিক মিয়া ছিলেন বাংলা সাংবাদিকতা জগতে পথ প্রদর্শক, তেমনই রাজনীতিতেও। রাজনৈতিক জগতে তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক মিয়ার গভীর সম্পর্ক ছিল তাকে বড় ভাই বলে সম্বোধন করতে এবং যখনই কোনো রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিতে তখনই তার কাছে পরামর্শের জন্য ছুটে আসতেন তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়া ঢাল ও বিশ্বস্ত বন্ধু।
এ দেশে সাংবাদিকতার জগতে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া একটি অবিস্মরণীয় নাম। ‘মোসাফির’ শিরোনামে তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভীক সত্য ভাষণ, অনন্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হৃদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন। মানিক মিয়া প্রচলিত অর্থে শুধুমাত্র একজন সাংবাদিক ছিলেন না। বরং সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির পথ রচনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
কে এই মানিক মিয়া কি তার পরিচয় ।।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। গ্রামের পূর্ব ভান্ডারিয়া (পাঠশালা) প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ভর্তি হন ভান্ডারিয়া হাই স্কুলে। ভান্ডারিয়া স্কুলে মানিক মিয়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
তারপর চলে যান পিরোজপুরে সেখানে আইনজীবী চাচা আফতাব উদ্দিনের বাসায় থেকে জেলা সরকারি হাই স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে চাকরি শুরু করেন। পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৩৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার অন্তর্গত গোয়ালদি গ্রামের অভিজাত পরিবারের খোন্দকার আবুল হাসান সাহেবের কন্যা মাজেদা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
এ সময় তিনি তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পিরোজপুরে আসলে মানিক মিয়ার মেধা ও চৌকস বুদ্ধির কারণে সোহরাওয়ার্দী সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আহ্বানে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগ দেন তদানীন্তন বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে বরিশাল জেলার সংযোগ অফিসার হিসেবে। কিছুদিন পর সে চাকরিও ছেড়ে তিনি কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। এ সময় কলকাতায় ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’।
ওখানে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে মানিক মিয়া যোগ দেন এবং এ পত্রিকার সাথে মাত্র দেড় বছর যুক্ত ছিলেন। ’৪৭ এর দেশ বিভাগের পর কিছুকাল কলকাতায় অবস্থান করে মানিক মিয়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। ১৯৫১ সাল থেকে তিনি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং বাঙালির ৫২ ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল অন্যতম।
১৯৫৩ সালে মানিক মিয়ার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ থেকে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এ রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীকালে দৈনিক ইত্তেফাক তৎকালীন ক্ষমতাধর আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর জেল খাটেন এবং ১৯৬৬ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন।
এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী বন্ধ হয়ে যায়।
গণআন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।