এইচ এম জুয়েল:- সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের আনাচে কানাচে পানি জমে গেছে। অনেকের বসতবাড়ি কিংবা বাড়ির উঠানে পানি এসেছে সাপের গর্তে ডুকার ফলে নানা রকম বিষধর সাপের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার ফলে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও প্রতিনয়ত বাড়ছে। প্রতিবছর সাপের কামড়ে অনেক মানুষ মারা যায়।অভিজ্ঞ ও হাতের কাছে চিকিৎসা না থাকায় মৃত্যুর হার বাড়ছে। বাংলাদেশের গ্রামঞ্চলে সাপের কামড় এখন একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।
চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক উন্নতি হয়েছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাপে কামড়ালে এখনও অনেক মানুষ হাতুড়ে ডাক্তার, ওঝা বা কবিরাজের শরণাপন্ন হয়।
সাপ থাকে গ্রামে, ওষুধ থাকে শহরে”তাতে রোগীরা পরে বিপাকে ! হাসপাতাল সূত্রে জানা গেলো, বিষধর সাপেকাটা রোগীদের জন্য সরকারিভাবে অ্যান্টি স্নেক ভেনম নামের ইনজেকশন বা ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়ে থাকে মেডিকেল কলেজ সমূহ ও জেলা সদর হাসপাতাল গুলোতে।
তবে উপজেলা হাসপাতাল গুলোতে অ্যান্টি স্নেক ভেনম ইনজেকশন না থাকায় গ্রামঞ্চলে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু দিন দিন বারছে। তাই এর ভ্যাকসিন আরও সহজলভ্য করে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে সরবরাহ করতে পারলে দেশে মৃত্যু কমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।প্রতি বছর বন্যার সময় অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই-এই তিন মাসে সাপের দংশন বা তার কামরে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। এক জরিপে বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের মধ্যে ২৬টি প্রজাতি বিষধর| যার ১২ প্রজাতির অবস্থান সাগরে। বাকিগুলো গহীন জঙ্গলে এবং লোকালয়ে বসবাস করে। দেশে যেসব সাপ রয়েছে, তার মধ্যে ৭ থেকে ৮ প্রজাতির বিষধর সাপের কামড়ে মানুষের বেশি মৃত্যু ঘটে। সাপে কাটার ঘটনা গ্রামাঞ্চলে, এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি ঘটে থাকে। স্থলভূমিতে থাকা সাপ পায়ে বেশি দংশন করে। একজন সাপে কাটা রোগীকে কমপক্ষে ৫/৭টি ইনজেকশন দেওয়া হলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে ৮ লাখের বেশি মানুষকে সাপে কামড়ের শিকার হন এবং বছরে 6 হাজারের অধিক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়।
গবেষকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে সকাল ও সন্ধ্যায় সাপে বেশি কামড়ায় । চট্টগ্রাম, কক্সবাজার,খুলনা, বরিশাল,রাজশাহী, ময়মনসিংহ এলাকায় সাপের কামড় এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে প্রায় ২লাখ মারা যান । এবং ভারতের নদীয়া ও ২৪ পরগনা জেলায় পৃথিবীর সবচেয়ে সাপে কাটাপ্রবণ এলাকা।
সাপ শান্ত প্রানী প্রকৃতপক্ষে মানুষ শিকার করে না বরং সাপকে কোনো কারণে উত্তেজিত বা আঘাতগ্রস্থ না হলে তারা মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। সাপের কাছাকাছি মানুষের হাত–পা চলে এলে সাপ অনেক সময় ভয় পেয়ে ছোবল মারে। উত্ত্যক্ত না করলে বা খুব ভয় না পেলে সাপ ছোবলে বিষ প্রয়োগ করে না। এই ধরনের বিষহীন কামড়কে ইংরেজিতে ড্রাই বাইট বলা হয়। সাপের বিষ মহা মূল্যবান সম্পাদ বিশ্ব বাজারে তার অনেক দাম। এটাকে বলে
তরল ডায়মন্ড যা কোটি টাকা মূল্য। প্রাণঘাতী জীবন রক্ষাকারী ঔষধে ব্যবহার করা হয়।
সাপের বিষ কি?:-সাপের বিষ হচ্ছে ঘনীভূত রূপান্তরিত লালা। সাপের চোখ আর ওপরের মাড়ির মাঝ বরাবর একটি গ্রন্থিতে বিষ থাকে। সাপের বিষ প্রধানত সাপের শিকারকে চলাচলের শক্তিহীন করতে আর খাদ্যের টিস্যু ভাঙার হজমের কাজে ব্যবহারের জন্য। সাপের বিষ হালকা হলুদ বর্ণের চটচটে পদার্থ। এতে প্রায় কুড়ি ধরনের উপাদান আছে। মূল উপাদান প্রোটিন, পলিপেপটিটেড, এনজাইম, টক্সিন ও অন্যান্য উপাদান। সাপ জানে, তার বিষ খুব মহার্ঘ্য।
তাই সাপ তার নিজ সম্ভাল বিষ বুঝেসুঝে সেটা খরচ করে।
দেশে যত সাপ আছে, তার সামান্যই আমরা দেখতে পাই। সাপ গর্তনিবাসী, সাপের দেহ নাজুক, হাত–পা নেই, তার ওপর কানে শুনতে পায় না, দূরের দৃষ্টিও খারাপ। খাবারের জন্য লড়াই কম করতে হয়| ফলে সাপের সবই প্রবৃত্তিনির্ভর।সাপ বাইরে খোলা জায়গায় ঘোরাফেরা কম করে।
মূলত” গোখরা (কোবরা) ও কেউটে (ক্রাইট) সাপের কামড়ে মানুষের বেশি মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে কেউটে সাপ বাড়ির আশপাশে রান্নাঘর ও গোয়ালঘরে লাকড়ির মধ্যে থাকে। আর গোখরা সাপ ফসলি জমি ও রাস্তাঘাটে থাকে। গোখরা ও কেউটে সাপের বিষক্রিয়ায় পার্থক্য আছে। গোখরার কামড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়, চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আর কেউটে সাপের কামড়ে শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। পাশাপাশি কামড়ের স্থান ও দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হয়।তবে বাংলাদেশে গোখরা ও কেউটো এই দুটি সাপের দংশনের ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় একই ওষুধ ব্যবহার করা হয়।যার ক্রিয়া এক নয়।
সাধারনত” সাপ থেকে বাচার উপায় সাপের এরিয়ায় গেলে উচুজুতা (গামবুট) পরা, মোটা কাপরের জিন্স প্যান্ট পরা, রাতের টর্চ লাইট সাথে রাখা এবং কার্বলিক এসিড সাথে বা ঘরে ব্যবহার করা।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বাংলাদেশে যে অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করা হয়, তা ভারতের তামিলনাড়ু থেকে আসে।সেই ভ্যাকসিন মূলত ওখানের চার ধরনের সাপের বিষ দিয়ে মিশ্রিত করে অ্যান্টিভেনম তৈরি করে থাকে যা সাপের দংশন নিরাময়ে কাজ করে তবে অঞ্চলভেদে সাপ যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি বিষের মাত্রায় তারতম্য থাকে।তামিলনাড়ু সাপের বিষের সাথে আমাদের দেশের সাপের বিষে অনেক তফাত আছে। ভারত থেকে যে অ্যান্টিভেনম আনা হয়, তার মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে| যা চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সেগুলো আংশিক কাজ করে। তাই ভ্যাকসিনের কার্য ক্ষমতা কম হওয়ায় সাপে কাটার রোগীর মৃত্য ঘটে বেশি।এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হচ্ছে, যেখানকার মানুষকে সাপ কেটেছে, সেখানকার স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি করে দিতে হবে। না হলে তা কার্যকর হয় না।
কার্বলিক এসিড সাপে খুব ভয় পায়।
আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব অ্যান্টিভেনম আমদানি করে, তার মেয়াদকাল থাকে ৪ বছর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো মাঠ প০ পর্যেন্ত বিতরণ করা হয় ২/৩ বছর পর। এবং
অধিকাংশ চিকিৎসকই সাপের বিষের চিকিৎসা সম্বন্ধে ভালো জানেন না।তারা সাপের জাতও ভালো করে চেনেন না। উপসর্গ বোঝেন না, রোগীর আত্মীয়দের বোঝান, তাঁদের কাছে সিরাম নেই। অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। নেওয়ার পথেই অধিকাংশ রোগীর মৃত্যু ঘটে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়ে কালকেউটের কামড়ে। বাংলাদেশের সর্বত্র এই সাপ পাওয়া যায়।তবে এলাকা ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন নাম তার। দক্ষিণবঙ্গে কেউটে, বরিশালে কালিঞ্জিরি, চট্টগ্রাম হানাস, উত্তরে জাতিসাপ নামের এরা পরিচিতো এই সাপ লম্বায় তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়। এরা জলে অথবা জলের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। এদের বিষে নিউবোটক্সিন থাকায় কামড়ালে বা বিষ প্রয়োগ করলে মানুষ বাঁচানো প্রায় অসম্ভব।
সাপে কাটা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত ভ্যাকসিন এন্টিভেনম খুবই দামি। একটি এন্টিভেনমের মূল্য প্রায় ১৫০০ ডলার। যদিও প্রতিটি দেশের সরকার ভর্তুকি দিয়ে তা জন সাধারণের কাছে সরবরাহ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপে কামড়ানো রোগীকে বেশি নড়াচড়া করতে দেয়া যাবে না, আক্রান্ত জায়গা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে। লক্ষ রাখবেন বেশি টাইট করে বাঁধা যাবে না। বাঁধলে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়ে গ্যাংগ্রিন হতে পারে।আক্রান্ত জায়গায় কাঁচা ডিম, চুন, গোবর কিছুই লাগাবেন না। এতে সেল্যুলাইটিস বা ইনফেকশন হয়ে রোগীর জীবনহানি ঘটতে পারে।
সাপের বিষ শিরা দিয়ে নয়, লসিকাগ্রন্থি দিয়ে শরীরে ছড়ায়। দ্রুত কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করে হাসপাতালে নিতে হবে। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে ২৪ ঘণ্টার আগে ছুটি দেয়া যাবে না।
এদিকে, সাপের কামড়ে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিত্ব কমিয়ে আনতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত মেয়াদে একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরিকল্পনায় অ্যান্টিভেনম উৎপাদন ও সরবরাহকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সেটির অংশ হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদি ২০১৮ সালের মার্চে বাংলাদেশে অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রকল্পটি শুরু হয়।এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সম্প্রতিক ভান্ডারিয়া সাপে কাটা এক রোগী উপজেলা হসপিটালে চিকিৎসা না পেয়ে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল এ যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করে। উপজেলা পর্যায়ে সাপে কাটা ভ্যাকসিন থাকলে এরকম হাজারো মৃত্যু হয়তো হত না।