দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে চা দিবস
শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি
এইচ এম জয়েল:- আজ (৪ জুন) দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে চা দিবস । দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে অনেক চাহিদা আর উচ্চমূল্যের কারণে চা-পাতার ব্যবসা অনেক লাভজনক হলেও মালিকদের নানা অজুহাতে বাড়ছে না চা-শ্রমিকদের মজুরি। এ কারণে যুগ যুগ ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা-শ্রমিকরা ঘটেনি শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন। চা-শ্রমিকদের কোথাও আশার আলো নেই, নেই উন্নত জীবনের স্বপ্নও। কারণ তারা চা-শ্রমিক। তাই তাদের সন্তানরাও পেরোতে পারছেন না বাগানের গণ্ডি। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এ পেশায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া এসব মানুষের ভাগ্যও বদলাচ্ছে না। চা-পাতা কুড়িয়ে জীবন পার হয় তাদের। বংশ পরম্পরায় যুবক থেকে বৃদ্ধ হন এই চা-পাতা তুলে। এ যেন চা-বাগানের গণ্ডিতেই তারা তাদের পুরো জীবন পার করেন।
চা বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৬৬টি চা বাগান আছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি ও সিলেট জেলায় আছে ১৯টি চা বাগান। বাকিগুলো চট্টগ্রাম, পঞ্চগড় জেলায়।
বর্তমানে এসব বাগানের চা শ্রমিকরা দৈনিক সর্বোচ্চ ১২০ টাকা মজুরি পান। এই স্বল্প মজুরিতে চা-শ্রমিকরা খেয়ে-না-খেয়ে কোনো রকমে দিনাতিপাত করেন। অনেকক্ষত্রে সপ্তাহ মাস আটকে যায় তাদের মজুরি। যুগ যুগ ধরে তারা এই বঞ্চনার শিকার। শুধু এই মজুরির বঞ্চনাই নয়, তাদের বাসস্থানও স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
গত আগস্টে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের আহ্বানে দেশব্যাপী চা-শ্রমিকরা একযোগে মজুরিসহ নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে একপর্যায়ে সরকার উদ্যোগ নিয়ে তাদের মজুরি ১৮ টাকা বৃদ্ধি করে। আগে এই মজুরি ছিল ১০২ টাকা।
দেশের বিভিন্ন বাগানের চা-শ্রমিক মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি জানাচ্ছেন প্রতি বছরই। কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। চা-শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন সেই অবহেলিতই রয়ে গেছে।
এদিকে বর্তমান যুগেও চা-শ্রমিকদের লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে থাকতে হচ্ছে। কয়েকটি চা-বাগানে শ্রমিকদের বাসস্থানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। চুক্তি কিংবা খাতাপত্রে শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্যের প্রথম শর্ত হিসেবে একটি পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণের কথা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো নজির পাওয়া যায় না।
ছন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় শ্রমিক পরিবারকে। ঝড়-বৃষ্টিতে ঘরে বসে থেকেও তাদের ভিজতে হয়। টিনের চাল দিলে আর এ অসুবিধা হতো না।
সুনীল রিকিয়াশন নামের এক শ্রমিক জানান, স্ত্রী লছমী রিকিয়াশনসহ তার পরিবারের সদস্য নয়জন। অথচ চা-বাগান মালিকপক্ষ থেকে যে ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে সেখানে দুই থেকে তিনজন বসবাস করতে পারেন। বাকিরা ঘরের দাউঠানে ঘুমান, বৃষ্টি হলে তখন এক ঘরে গাদাগাদি করে সবাইকে ঘুমাতে হয়।
চা শ্রমিকরা জানান, বাগানের হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার অভাব রয়েছে। বাগানে যে কয়েকটা ছোট হাসপাতাল রয়েছে তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ ও ডাক্তার না থাকায় রোগমুক্তি হচ্ছে না। অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। তাছাড়া বাগানের কিছু কিছু ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও চাকরির ক্ষেত্রে বড় কোনো পদ পাচ্ছে না।
এদিকে দুটি পাতার একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে পরিচিত সিলেটে ১৮৫৪ সালে মালনীছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চা চাষ শুরু হয়। এরপর সময়ে সময়ে বেড়েছে চা বাগানের সংখ্যা। বেড়েছে এই খাতে শ্রমিকের সংখ্যাও। তবে চা-বাগান অঞ্চলে কাজ করা বেশিরভাগ শ্রমিকরাই অতিদরিদ্র।
বেসরকারি সংস্থা দি লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল ও হিড বাংলাদেশের তথ্যমতে, চা-বাগান অঞ্চলে প্রতি ১০ হাজারে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ২০ জনের অধিক। তবে ২০২১ সালে করোনাভাইরাসের কারণে কুষ্ঠ রোগী শনাক্তকরণে বিলম্ব হয়। হয় বাধাগ্রস্তও। তারপরেও চলতি সিলেট জেলায় ২৪ জন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, বর্তমানে চা-শ্রমিকরা যে মজুরি পাচ্ছেন তার মিল নেই বাজার মূল্যের সঙ্গে। বাগানের চায়ের উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে চায়ের দামও বেশি। কিন্তু বাগান মালিকপক্ষ নানা অজুহাতে সঠিক মজুরি দিতে রাজি হন না।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট শাখার সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, চা-শ্রমিকরা যুগযুগ ধরে বঞ্চনার শিকার। তারা সারাদিন কাজ করলে যে মজুরি পান তা দিয়ে একজন মানুষও খেয়ে বাঁচতে পারবে না। এরপর চিকিৎসা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদাও মিলছে না বাগানে। এসব সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো চা দিবস পালন করা হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে চা-শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা করব। কারণ এই শিল্পের সঙ্গে অনেক মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে।