গত বৃহস্পতিবার (2 সেপ্টেম্বর) পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার পৈকখালী গ্রামে নিজ বাড়িতে হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। শুক্রবার জানাযার শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। তার জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মকর্তা, রাজনৈতিক, সামাজিক, বিভিন্ন পেশার হাজার জনতা।
কে এই আলতাফ হোসেন” কি তার পরিচয়?
দক্ষিণের জনপথ পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার পৈকখালী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৬৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় সমাজপতি মোঃ ফজলুর রহমানের ৯ সন্তানের মধ্যে আলতাফ হোসেন, মেজ পুত্র। ছোটবেলা থেকেই সাবলীল ও মিশুক ছিলেন স্থানীয় পৈকখালী হাই স্কুল থেকে ১৯৮১ সনে বিজ্ঞান বিভাগে ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে কৃতিত্ব তার সাথে এসএসসি ও ১৯৮৩ ভান্ডারিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের ছাত্র রাজনীতির ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হন।
এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোকে কোনঠাসা করে ছাত্রলীগকে সামনের সারিতে নিয়ে আনার জন্য নেতা-কর্মীদের কাছে মুজিব সেনানী হিসেবে আলতাব হোসেন (বাঁধন) এর নাম তুঙ্গে ওঠে এবং ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু হলে ৩০৮ নং রুম তার জন্য বরাদ্দ থাকলেও নেতাকর্মীদের সাথে সঙ্গ দেওয়ার জন্য জহুরুল হক হলে বেশি সময় কাটিয়েছেন। রাজনীতিতে যখন চারিদিকে রব উঠেছে ঠিক তখনি তাকে দমিয়ে রাখার জন্য তখনকার শাসকগোষ্ঠী এক চক্রান্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় টি স্টোর থেকে ডিবি পুলিশ একটি আগ্নেয় অস্ত্র স্টেনগান উদ্ধার করে এবং সেই মামলায় আসামি বানিয়ে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আলতাফ হোসেনের উপায় ব্যাপক টর্চারিং করেন। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুজিব সৈনিক হিসেবে তার ভূমিকা ফ্রন্টলাইনে ছিল। ৯০ এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ায় সময় সরকারদলীয় মাস্তান ও প্রশাসনের টিয়ার সেল লাঠির আঘাতে আলতাফ হোসেন গুরুতর আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় দুই নেত্রী ( শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ) হসপিটালে গিয়ে তার চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে দেশব্যাপী তার নাম ছড়িয়ে পড়েন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ছাত্র রাজনীতিকে আবারো সামনের সারিতে নিয়ে আসার জন্য মুজিব সেনা আলতাফ কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেন। দুঃখের বিষয় তারই সহযোদ্ধা তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ( মনিরুজ্জামান বাদল ) নিজ দলের বিশ্বাসঘাতকদের হাতে ১৯৯২ নিহত হওয়ার পর সাংগঠনিকভাবে আলতাফ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সে যাত্রায় নিজের জান বেঁচে যায়।
পরবর্তীতে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে ১৯৯৪ সনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনে সেক্রেটারি পদে জন্য নমিনেশন দাবি করেন কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগের রাঘব বোয়ালরা চক্রান্ত করে ওই পথ থেক তাকে দূরে সরিয়ে (শামীম- পান্না) প্যানেল তৈরি করেন এবং সম্মেলনে মাধ্যমে এনামুল হক শামীম সভাপতি ও ইসাহাক আলী খান পান্না কে সেক্রেটারি নির্বাচিত করেন। এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে আলতাফ হোসেন ছাত্রলীগের একাংশ নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। সেই আন্দোলন থামাতে ওই কমিটিতে সান্তনা পুরস্কার হিসেবে আলতাফ কে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রস্তাব দিলে তিনি তাহা প্রত্যাখ্যান করেন এবং দলের জন্য জীবনকে বাজি রেখে প্রাণের সংগঠন ছাত্রলীগকে সামনে নিয়ে আসছেন সেই শ্রম, ত্যাগ ও রক্ত বিন্দু বিপর্যয় হয়ে যাওয়ার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আস্তে আস্তে তিনি মানসিক রোগীতে পরিণত হন। ওই সুযোগে তৎকালীন বিএনপি সরকারের রোষানলে পড়ে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় হামলার শিকার হয়ে জেল খাটেন। তখনকার কোন আওয়ামী লীগের নেতার-কর্মী তার পাশে দাঁড়াননি এবং খোঁজ খবর নেননি। একমাত্র সম্বল তারই ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র এ কে এম জহিরুল হক (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) তিনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামিনে মুক্ত করেন। মুক্ত হওয়ার পর আলতাফ হোসেন সেই চির চেনা মুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের আশে পাশে বেশ কয়েক বছর (ভবঘুরে) উম্মুক্ত ঘোরাঘুরি করেন।
রক্ত ও শ্রম দিয়ে এগিয়ে নেওয়া প্রাণের সংগঠন আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে অনেক পাতি ভুঁইফোড় নেতার ভাগ্য বদল হলেও আলতাফের কপালে কিছুই জোটে নি।আলতাফকে যারা ব্যবহার করেছিল অনেক নেতা তখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে।
পাহাড় সমান কষ্টকে বুকে নিয়ে পরিশেষে ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে দেশ ভ্রমণে বের হলে বাংলাদেশের উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের সীমান্ত থেকে ভারতীয় বিএসএফ গুপ্তচর ভেবে আটক করলে জান বাঁচানো জন্য কোন কথা না বলে সুকৌশলে তাদের কাছে বোবা সাজে। পরবর্তীতে বিএসএফ ভারতের জলপাইগুড়ি আদালতে হাজির করলে বিচারকের সাথে আসামি হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিল আমি নির্দোষ আমি কোন গুপ্তচর বা চোরাকারবারি নই এখনো অবিভক্ত বাংলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি এটা বাংলার জমিন, বিচারক হতভম্ব হয়ে পাসপোর্ট আইনে কারাদণ্ড দেন। ওখানের কারা ভোগ করে নিজ জন্মস্থান পিতা-মাতার কাছে চলে আসলে পরিবারের লোকেরা সাধ্যমত চিকিৎসা সেবা করান। কিন্তু দুর্দিনের সেই লড়াকু মুজিব সৈনিকের কথা সুদিনে কেউ মনেও রাখেননি নিদারুণ দুর্বিষহ জীবন কেটেছে তার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শুধু মুখে একটি নাম জপে যেতেন “মহারাজা-মহারানী শেখ ধর্ম! জাতির পিতার টুংগীপাড়ায়“এবং শোকের মাস আগস্ট আসলেই পুরো মাস জুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য রোজা রাখতেন। যাক ফিরে যাই! ২০০৮ সালে ফের আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তৎকালীন নিজ আসনের এমপি অধ্যক্ষ শাহ আলম, আলতাফ হোসেনের দুর্দশা কথা শুনে সর্বপ্রথম তাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে আর্থিক সহায়তা করেন সেই টাকা দিয়ে আলতাফের কিছু দিন ভালই চলছিলো। এরি মাঝে বাবা মারা যাওয়ার পর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আলাদা ভাবে খানাপিনা শুরু করেন কোন মতে দিন পার করেন বহুদিন কেটে গেছে এভাবে, তার এই পরিস্থিতি দেখে সাবেক ছাত্রলীগের কিছু মানবিক কর্মীরা ভাণ্ডারিয়ার কৃতিসন্তান তখনকার প্রধানমন্ত্রীর (পিএস-১) তোফাজ্জল হোসেন রিপন মিয়ার শরণাপন্ন হলে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আলতাফ হোসেনের দুর্বিষহ জীবনের কথা জানালে তিনি চমকে গিয়ে বলে আলতাফ তাহলে বেঁচে আছে। ও কোথায় ওর যাকিছু প্রয়োজন আমি দেখব ওকে নিয়ে আসো। ও আমার দুর্দিনের সৈনিক । তারই কথা মত, ২০১৮ সনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফাইজুল কবির, জিয়াউল হাসান মামুন ও শফিক মন্নান সহ আরো অনেকে মিলে আলতাফকে ঢাকায় নিয়ে যান।
এবং প্রধানমন্ত্রী কথামতো শ্যামলী মানসিক হসপিটালে ভর্তি করান। হসপিটালে থাকাকালীন সাবেক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তার প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তৈরি করেন অর্থ ফান্ড এবং তিনজন ফাইজুল, মামুন ও শফিক এর নামে যৌথ একাউন্ট খুললে সে ফান্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবিক অনুদানের দেওয়া ১০ লক্ষ টাকার পাশাপাশি সাবেক ছাত্রলীগের দেশে ও বিদেশে থাকা নেতাকর্মী ও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীরা ওই যৌথ একাউন্টে অনুদান দেওয়া শুরু করেন। এবং সেই চিরচেনা আলতাফকে একনজর দেখার জন্য হসপিটালে ও ছুটে যান।
বর্তমানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সহ অসংখ্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এদিক আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ও ভান্ডারিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম তার প্রতি মানবিক হাত বাড়িয়ে দেন তার বসত ঘরটি সংস্কার করেন।
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট এম এ হাকিম হাওলাদার। আলতাফ হোসেনের আপন ফুফাতো ভাই।
এদিকে: মানসিক হসপিটালে তার মন মোটেও টিকেনি করোনার শুরুর দিকেই সেখান থেকে পালিয়ে ফিরে আসেন আবারও পৈত্রিক ভিটায়। সেখানে শত বছরের কাছাকাছি বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আবারো শুরু করেন বেঁচে থাকার লড়াই। এলাকায় আওয়ামী লীগের কোন অনুষ্ঠান হলে সেখানে ছুটে গিয়ে দর্শক সারিতে সামনের কাতারে বসে মন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে শুনতে বক্তার বক্তব্য। ছোট-বড় সকলের সাথে মিষ্টি ও সাবলিন ভাষায় কথা বলতেন। পোশাকেও ছিল আলাদা একটা স্টাইল প্যান্টের সঙ্গে গায়ের শাট জড়িয়ে ক্রস বেলট। খানাপিনায়ও ছিল আলাদা মেনু, এই রুচিশীল সুষম দেহের অধিকারী মানুষটির সহপাঠী, সহযোদ্ধারা ঘর সংসার সহ উচ্চ বিলাসী রঙিন জীবন যাপন করলেও হতভাগা মুজিব সেনানী ব্যাচেলর জীবন নিয়ে ৫৫টি বছর কেটে গেছে জেল, জুলুম, নির্যাতন আর বঞ্চনায়। হাতের কাছে সুখের পাখিটা উড়লেও ধরা দেয়নিতা তার জীবনে। অবশেষে এক বুক ব্যথা ও এক রাস অভিমান নিয়ে গত বৃহস্পতিবার (2 September) অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্ত হয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
মায়ের আবদার: আলতাফ হোসেনের বেঁচে থাকা শতবছরের বৃদ্ধ মায়ের রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে দাবি তার ছেলেটি দুনিয়ায় ঔরসজাত কোন বংশ রেখে যেতে পারলেন না তাই তার নামে প্রধানমন্ত্রীসহ শুভাকাঙ্ক্ষীদের দেওয়া ফিক্সড ডিপোজিটে রাখা টাকা গুলো দিয়ে কবরের নিকট জামে মসজিদের সাথে তার নামে একটি নূরানী হেফজখানা মাদ্রাসা তৈরি করা জন্য জোর দাবী তুলছেন।
বিঃদ্রঃ এই প্রতিবেদন টি লিখতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে বিখ্যাত শিল্পী হায়দারের সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল “আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার”বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার।
পাঠক বন্ধু: তথ্য-উপাত্তে অনেক ভুল থাকতে পারে দয়া করে আলতাফ ভাইয়ের সম্বন্ধে আরো কিছু কারো জানা থাকলে আমাকে জানাবেন সংযোজন ও বিয়োজন করার সুযোগ আছে। #01711031632#